গত ১০ই অক্টোবর যখনই আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, যিনি একইসঙ্গে স্বাস্থ্য ও স্বরাষ্ট্র দফতরের পূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন,সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “আমাদের কোন কিছু লুকোনোর নেই ,আমরা চাই অপরাধী ধরা পড়ুক এবং তার ফাঁসি হোক!” তাঁর আচার আচরণ ও বিবৃতির ভাষার সঙ্গে পরিচিত অভিজ্ঞ সাংবাদিক ও বিরোধীদলের নেতাদের একাংশ টিভি চ্যানেলে এই বক্তব্য দেখে শুনে জনান্তিকে মন্তব্য করেছিলেন, তাহলে অবশ্যই তাঁর ” কিছু লুকানোর ” আছে ! ততক্ষণে অবশ্য সামনে এসে গেছে একদিন আগে হাসপাতালে কর্তব্যরতা তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাকে চাপা দেওয়ার জন্য অধ্যক্ষ ডাঃ সন্দীপ ঘোষ এবং তাঁর বশংবদ চিকিৎসক ,জুনিয়র ডাক্তার এবং হাসপাতালের অন্যান্য কয়েকজন আধিকারিকের অতি তৎপরতা ।

মৃতদেহের পোস্ট মর্টেম ও অস্বাভাবিক মৃত্যুর অভিযোগ দায়ের করার সময়ের মধ্যে অসঙ্গতি , ৯ ই আগস্ট সন্ধ্যায় বাম ছাত্র যুব নেতৃবৃন্দের বাধা জোর করে সরিয়ে দিয়ে পুলিশি পাহারায় তিলোত্তমার মৃতদেহ সোদপুরের কাছে নাটাগড়ে তাঁর বাবা মা পৌঁছনোর আগেই তাঁদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া এবং স্থানীয় বিধায়ক এবং কাউন্সিলরের উদ্যোগে পানিহাটি শ্মশানে দাহ করার খবর জানাজানি হয়ে গিয়েছিল ঘটনার পর মুখ্যমন্ত্রী প্রথমবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়ার আগেই। সংবাদ মাধ‍্যম চাপা দিতে চাইলেও টেলিভিশন চ্যানেলের টক শোতে বামপন্থী প্রতিনিধিরা বার বার মনে করিয়ে দিয়েছেন, পানিহাটি শ্মশান থেকে তিলোত্তমার শবদাহের সার্টিফিকেট তাঁর বাড়ির লোকের বদলে সংগ্রহ করেছেন স্থানীয় এক তৃণমূল কংগ্রেস নেতা। স্বভাবতই মুখ্যমন্ত্রীর কথার সঙ্গে তাঁর দপ্তরের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থাকা আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও কলকাতা পুলিশের কাজকর্ম ও সদিচ্ছার কোনও মিল প্রথম থেকে ছিলনা । ঘটনার দিনই মেডিক্যাল কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ ডাঃ সন্দীপ ঘোষ এফ আই আর করেন নি কেন- এই প্রশ্নের সদুত্তর বাইশ দিন পরেও পাওয়া যায় নি। আইন বিশেষজ্ঞ ও প্রাক্তন পুলিশ আধিকারিকদের অনেকেই মনে করছেন, শুধুমাত্র এই গাফিলতির কারণেই তৎকালীন অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করা উচিত ছিল কিন্তু প্রথমে কলকাতা পুলিশ ও পরে সিবিআই তদন্ত চলাকালীন তাঁকে হেফাজতে নেওয়া হয়নি। এমনকি প্রাক্তন অধ্যক্ষের পলিগ্রাফ টেস্ট হয়েছে সাধারণ জিজ্ঞাসাবাদের ধরণেই। অথচ কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে কলকাতা পুলিশের হাত থেকে এই ঘটনার তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে চলে গেছে ঘটনার পাঁচ দিনের মাথায়। এই নারকীয় ঘটনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত সন্দেহে এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে কলকাতা পুলিশ গ্রেফতার করেছিল একদিনের মাথায় । সিবিআই তাকেই হেফাজতে নিয়েছে আর কোনও সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করতে পারেনি। ফলত সন্দেহ জাগছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ পাচ্ছে তো? সিবিআই তদন্ত শুরুর ঠিক আগেই ১৪ই আগস্ট কলকাতা সহ সারা বাংলা যখন তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের অপরাধীদের শাস্তির দাবীতে রাতজাগা প্রতিবাদে উত্তাল তখনই রহস্যজনক ভাবে গভীর রাতে দুষ্কৃতীরা ভাঙচুর চালায় আর জি কর হাসপাতালে। তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা জনসমক্ষে আসার আগেই অনেক প্রমাণ লোপাট করা হয়েছিল এমন অভিযোগ তাঁর বাবা মা প্রথম থেকেই করে আসছিলেন। অতি সম্প্রতি ফাঁস হয়ে যাওয়া ঘটনা ঘটার পরের ৪৩ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে তিলোত্তমার মৃতদেহ যে সেমিনার হলে পাওয়া গিয়েছিল সেখানে পুলিশ আইনজীবি ও তৎকালীন অধ্যক্ষ ডাঃ সন্দীপ ঘোষের অনুগত কয়েকজন চিকিৎসকসহ অনেক মানুষ। ফলে প্রমাণ লোপাটের অভিযোগ আরও জোরদার হচ্ছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রী ও পুলিশ মন্ত্রী হিসাবে এই ঘটনা পরম্পরার কোনও দায় অস্বীকার করতে পারেন না মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি । তাঁকে চেয়ারে রেখে এই তদন্ত সঠিকভাবে সম্ভব কিনা সেই প্রশ্ন থাকছে। সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তও এখন সিবিআইয়ের হাতে। সন্দীপ ঘোষের নেতৃত্বে ঘটে চলা আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিন যাবৎ সরব হয়ে বদলি হয়ে যাওয়া প্রাক্তন অতিরিক্ত সুপার আখতার আলির করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে শুরু হয়েছে সিবিআই তদন্ত।

সংগঠিত অপরাধের চেনা বৈশিষ্ট্য হলো অপরাধীদের পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং অপরাধের পাণ্ডাদের পক্ষ থেকে পরিকল্পনার মাফিক ঐ অপরাধের সঙ্গে যুক্ত কোনো চুনো পুঁটিকে আসামী সাজিয়ে তাকে ফাঁসানোর জন্য উপযুক্ত পারিপার্শ্বিক প্রমাণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে মূল অপরাধের যাবতীয় প্রমাণ লোপাট করা। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে কর্তব‍রত তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার ক্ষেত্রে তেমনই ঘটেছে এমন ধারণা তৈরি হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে । এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি তিলোত্তমাকে খুন কারা করেছিল এবং কেন? কাদের প্রশ্রয়ে এই জঘন্য ঘটনা ঘটেছে? এখনও পর্যন্ত পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণ তদন্তকারী কেন্দ্রীয় সংস্থার হাতে এল না কেন? যদি তথ্য প্রমাণ সরিয়ে ফেলা হয়ে থাকে তাহলে এই কাজ কাদের নির্দেশে হয়েছে?

পুরো ঘটনার পিছনে রাজনীতির যোগাযোগ পরিস্কার । অরাজনৈতিক প্রতিবাদ হলেও অপরাধের পাণ্ডাদের রাজনৈতিক প্রভাব থাকলে বিচারের দাবিতে রাজনীতির রং লাগবেই। তিলোত্তমার হত্যা ও ধর্ষণের দায় এবং আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দুর্নীতির দায় কাদের তা মুখ্যমন্ত্রীই সবচেয়ে ভালো জানেন বলেই প্রতিবাদের কন্ঠরোধ করতে চাইছেন। তিলোত্তমার মৃতদেহ নিয়ে যেতে যারা বাধা দিয়েছিল তাদের পুলিশি হেনস্থা থেকে দুর্গাপুরে তাদের পার্টি অফিসে হামলা – কোন কিছুই বাদ দিচ্ছেন না।