আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের পদত‍্যাগী অধ‍্যক্ষ ডাঃ সন্দীপ ঘোষকে হেফাজতে না নিয়ে তাঁর পলিগ্রাফ টেস্ট কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে নাগরিকদের একাংশের প্রশ্ন উপেক্ষা করা যাচ্ছে না এই কারণে যে, গত ৮ ই আগস্ট আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে পিজিটি চিকিৎসক ছাত্রীর ধর্ষণ ও খুনের ঘটনাকে যথাসময়ে আইনের নজরে না আনার মত ঘটনা ও প্রমাণ লোপাট করা অভিযোগের সঙ্গে ডাঃ সন্দীপ ঘোষের নাম যুক্ত হয়ে যাওয়ার পরেও কলকাতা পুলিশের মতো সিবিআইও এখনো পর্যন্ত তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের মধ‍্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে। তারা চারজন পড়ুয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে কিন্তু কাউকেই আটক করেনি। অথচ কলকাতা হাইকোর্টে এবং সুপ্রিম কোর্টে সিবিআই অভিযোগ করেছে যে ঘটনা ঘটার সময়, ময়নাতদন্তের সময় এবং অভিযোগ নথিভুক্ত করার সময়ের মধ‍্যে যা ব‍্যবধান তাতে ধর্ষণ ও খুনের প্রমাণ নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সুপ্রিম কোর্ট নিজের করা স্বতঃপ্রণোদিত মামলার শুনানি চলাকালীন এই প্রশ্ন তুলেছেন। লাভের মধ‍্যে লাভ গত দেড় বছর যাবৎ ডাঃ সন্দীপ ঘোষ আর জি করের অধ‍্যক্ষ থাকাকালীন তাঁর বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে তার তদন্তের ভারও সিবিআই নিয়েছে। ডাঃ সন্দীপ ঘোষ অবশ্যই চাইছেন এই নির্দেশের বিরুদ্ধে ডিভিশন বেঞ্চে গিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে রাজ‍্যের গঠন করা সিট এর আওতায় থেকে এই তদন্ত চলুক। রায়ের কপির অপেক্ষায় রয়েছেন তিনি, কিন্তু আমাদের পক্ষে এটা বুঝে ওঠা মুশকিল চিকিৎসক ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার আটচল্লিশ ঘন্টার মধ‍্যে আর জি কর হাসপাতালে গিয়ে অপরাধীর ফাঁসি চাওয়া মুখ‍্যমন্ত্রী মমতা ব‍্যানার্জীর সরকার কেন সুপ্রিম কোর্টের করা স্বতঃপ্রণোদিত মামলায় কোটি কোটি টাকা খরচ করে কপিল সিব্বলের মতো নামী আইনজীবী সহ একটি বড়োসড়ো আইনজীবীর দল পাঠিয়েছেন রাজ‍্যের পুলিশের ভূমিকা যথাযথ এবং এই অপরাধের কোন প্রমাণ নষ্ট হয়নি এই দুটি বিষয় প্রমাণ করতে। তাহলে কি মমতা ব‍্যানার্জী ও তাঁর স্বরাষ্ট্রদপ্তরের অধীনে থাকা কলকাতা পুলিশের কমিশনার বিনীত গোয়েল দুজনেই জানেন আরজিকর হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ ভবনে ধর্ষিতা ও নিহত চিকিৎসকের মৃতদেহ পাওয়ার পর থেকে ডাঃ সন্দীপ ঘোষদের ভূমিকা যথাযথ ছিল না? নয়ত টেণ্ডার ছাড়া ঘটনাস্থলের কাছে হাসপাতাল ভবনের অংশ পিডব্লুডি কে দিয়ে মেরামত করানোর নামে ভেঙেচুরে ফেলা হলো কেন? কেনই বা সিবিআই তদন্ত হাতে নেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তদন্তকারী দল আর জি কর হাসপাতালে তদন্তে পৌঁছনোর আগেই ১৪ ই আগস্ট মাঝরাতে হাসপাতালে ব‍্যাপক ভাঙচুর চালালো স্থানীয় কাউন্সিলরের ও আশেপাশের তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের পাঠানো লোকজন।পুলিশ নীরব দর্শক ছিল তখন।

এতটা নির্লজ্জভাবে অপরাধীদের আড়াল করার জন‍্য সমান্তরালভাবে প্রশাসন,আইন ও মিডিয়ার সাহায্য নিতে তৃণমূল কংগ্রেসকে অতীতে কখনও দেখা যায় নি। সাম্প্রতিক অতীতে ধর্ষণ খুনের মতো জঘন্য অপরাধকে লঘু করে স্বয়ং মুখ‍্যমন্ত্রী দেখিয়েছেন,মানহারা কন‍্যা বা জননীর পরিবার বাম রাজনীতি বিশেষত সিপিআই( এম) এর সঙ্গে যুক্ত বলে বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে গত ৮ ই আগস্ট চিকিৎসক ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুন করার ঘটনার পর প্রথম থেকেই ঐ মেডিক্যাল কলেজের পদত‍্যাগী অধ‍্যক্ষ ডাঃ সন্দীপ ঘোষের নেতৃত্বে প্রমাণ লোপাট করার উদ‍্যোগ নেওয়া হয়। ৯ ই আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ‍্যমন্ত্রী জননেতা প্রয়াত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শেষযাত্রার পরে তাঁর মরণোত্তর দেহদান কর্মসূচি থেকে মীনাক্ষী মুখার্জী,ময়ূখ বিশ্বাস,কলতান দাশগুপ্ত সহ ডিওয়াই এফ আই নেতানেত্রীরা সরাসরি আর জি কর হাসপাতালে পৌঁছে গিয়ে মৃতা চিকিৎসকের শববাহী গাড়ি না আটকালে হয়ত এতদিনে সবটাই ধামাচাপা পড়ে যেত। কারণ পুলিশ সেদিন দ্রুততার সঙ্গে সোদপুরের কাছে নাটাগড়ে মৃতা চিকিৎসকের বাড়িতে দেহ পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। ঘটনা নিয়ে মিডিয়াতে আলোচনা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তড়িঘড়ি ঘটনাস্থলে পাওয়া একটি ভাঙা ব্লুটুথের সূত্র ধরে সঞ্জয় রায় নামে এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেফতার করা হয় বটে কিন্তু মৃতদেহে পাওয়া অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন,ভাঙা গোড়ালি ইত‍্যাদি দেখে অভিজ্ঞ অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে কোন একজনের পক্ষে এই নৃশংস ঘটনা ঘটানো সম্ভব কিনা। কিন্তু প্রথম থেকেই কলকাতা পুলিশ গ্রেফতার হওয়া একমাত্র ব‍্যক্তিকেই অপরাধী হিসাবে দেখিয়ে নিজেদের তদন্তের সাফল‍্য প্রচার করতে চাইছে। যদিও গোটা রাজ‍্য ও দেশজুড়ে ওঠা প্রতিবাদের ঢেউ এবং মৃতা চিকিৎসকের মা বাবার দাবি মেনে কলকাতা হাইকোর্ট সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন এবং কলকাতা পুলিশের হাত থেকে অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়কে সিবিআই নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে। কিন্তু ঘটনাস্থলের এত পরিবর্তন ঘটানোর পর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহ করা যাবে কি? শুধুমাত্র বিবৃতির ওপর নির্ভর করে অপরাধী চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া সম্ভব। আমরা চমকে উঠবো না যদি ভবিষ্যতে দেখা যায় বার বার রাজ‍্য সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের ভালোবাসায় চাকরি বাঁচানো সন্দীপ ডাক্তারকে গুজরাটে বিলকিস বানোর ধর্ষকের মতো সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে।

কাজেই এই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে মানহারা নিহত তরুণী চিকিৎসকের বাবা মা ন‍্যায় বিচার পাবেন কি? তাঁরা স্পষ্টতই অভিযোগ করছেন

এখন অন্য খু ন ধ র্ষ ণে র সঙ্গে তাঁদের মেয়ের বিষয়টিকে গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তাঁদের চিকিৎসক কন‍্যা একটি সরকারি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজে কর্তব‍্যরত ছিলেন। সেখানেই তাঁকে ধ র্ষি ত হয়ে খু ন হতে হয়। এক্ষেত্রে সরকারের গাফিলতির বিষয়টি উপেক্ষা করা যায় না। শুধু তাই নয়, প্রশ্ন উঠছে
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে একটা দালাল চক্র কোটি কোটি টাকার খেলায় যুক্ত এবং আরজিকর হাসপাতালের দেওয়ালে কান পাতলে শোনা যায়, প্রশাসন ও হাসপাতাল যারা পরিচালনা করে তাদের প্রত‍্যক্ষ যোগাযোগ আছে এই দুর্নীতিতে।
নির্যাতিতা ও নিহত চিকিৎসকের পরিবারের আস্থা রাজ‍্য সরকার পুলিশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রথম থেকেই হারিয়েছেন দুঃসংবাদ পৌঁছনোর সময় এবং তার পরে নানা কৌশল অবলম্বন করার সময় থেকেই। চিকিৎসকের বাবা মাকে সাড়ে চার ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয়। প্রথমে বলা হয়েছিল ” আপনার মেয়ে অসুস্থ” তারপর বলা হয় “আ ত্ম হ ত্যা” র কথা । তাঁদের মেয়ের মুখটা দেখতে দেওয়া হয়নি। নিহত চিকিৎসকের বাবা মা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের বিরুদ্ধে তা হল,এমন একটা নৃশংস হ ত্যা কা ণ্ড। অথচ পুলিশ অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের করে। পুলিশ প্রথম থেকেই এটিকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এই ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে চাইছে। এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে আড়াল করতে চাইছে। কাউকে আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে। এমন কেউ জড়িত আছে যে তাকে সরকারের আড়াল করার প্রয়োজন আছে। সুপ্রিম কোর্টে রাজ‍্য সরকারের নিযুক্ত আইনজীবী বাহিনী এবং টিভি চ‍্যানেলে তাঁদের সওয়ালের ভাষায় তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের কথা বলা সেদিকেই ইঙ্গিত করছে।