অভয়া কিংবা নির্ভয়ার নাম এখনও পর্যন্ত প্রকাশ্যে কেউ বলেননি। কিন্তু আর. জি. করের ঘটনার পর পুলিশ কমিশনার বিনীদ গোয়েল নিজে নির্জাতিতার নাম বলেছেন, সন্দীপ ঘোষ নয় বার নাম নিয়েছেন নির্জাতিতার।

এখন প্রশ্ন হলো, নির্যাতিতার নাম নেওয়া যদি বেআইনি হয় তবে, সেই আইন ভাঙার অপরাধে পুলিশ কমিশনার বিনীদ গোয়েল ও সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী কি কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বা আদৌ কি কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? যদি কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে তবে সেটা স্পষ্ট করে জানানো হোক। আর যদি কোন ব্যবস্থা না নেওয়া হয়ে থাকে তো, সেটাও জানানো হোক ও কেন কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এবং কবের মধ্যে নেওয়া হবে তা জনসাধারণকে জানাক প্রশাসন।

প্রশাসন যেন ভুলে না যায় যে, ভারত একটি গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে জনগণের কাছে সমস্ত তথ্য প্রশাসনকে দিতে হবে। কেননা আমাদের করের টাকাতেই দেশ চলে। মুখ্যমন্ত্রী থেকে পুলিশ কমিশনারের মাইনে দেওয়া হয়। সুতরাং মুখ্যমন্ত্রী যতই রাজনৈতিক বক্তব্য রাখুন না কেন, আর যতই মুঘল আমল থেকে বামফ্রন্টের চৌত্রিরিশ বছর পর্যন্ত নানান উদাহরণ টেনে আনুন না কেন তার দুই দফতর (স্বরাষ্ট্র ও স্বাস্থ্য), যে দুই দফতরের তিনি মন্ত্রীও বটে; সেই দফতরের প্রধান দুই কর্তা ব্যক্তির এহেন বেআইনি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে নীরব থেকে কার্যত আইনকে রক্ষা করবার শপথ নিয়ে আইন ভেঙেছেন বা আইনের তোয়াক্কা করেননি মুখ্যমন্ত্রী -এই কথাটা স্পষ্ট করে বলতে হবে। এমটা যে তিনি প্রথম করেছেন তা নয়। এর আগেও এমন কাজ তিনি বহুবার করেছেন। সংবিধান হাতে নিয়ে বিধানসভায় ভাঙচুর করিয়েছেন। তার জন্য তিনি কোথাও দুঃখ প্রকাশ করেছেন? না, করেননি। বরং তিনি নিজেকে “রাফ্ অ্যান্ড টাফ্” বলে চিহ্নিত করে গর্ববোধ করেছেন একাধিকবার। আইনের রক্ষকরাই যদি বারবার এভাবে আইন ভাঙে, বেআইনি কার্যকলাপ করেন তবে “WE WANT JUSTICE” বলে চিৎকার করে লাভ কি? কার কাছে JUSTICE চাইবো? যিনি নিজেই বারবার আইন ভাঙেন তার কাছে? যিনি এই আইন ভঙ্গকারীকে রক্ষা করেন সেই পুলিশ, তার কাছে? নাকি মঙ্গল গ্রহের মঙ্গলদার কাছে?

ন্যায় বিচার পাওয়া যাবে কি যাবে না সেটা নির্ভর করে প্রশাসন যাঁরা চালাচ্ছে তাদের মানসিকতার উপর। জ্যোতি বসু যেমন বলতেন, সরকার না চাইলে দাঙ্গা হয় না। পরিষ্কার কথা। স্পষ্ট মনোভাব। দৃঢ় মানসিকতা। এর পরেও কি বুঝতে কোথাও অসুবিধা হয়, সেই প্রশাসন যারা চালাতেন তাদের মানসিকতা কেমন ছিল? আর এই সরকারের মুখ্যমন্ত্রী শপথ নেওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই দুষ্কৃতীদের ছাড়িয়ে আনতে সটান থানায় পৌঁছে যান। গনতন্ত্র? ক্ষমতার গরম?

বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় কবি, ঔপন্যাসিক ও ছড়াকার রেদোয়ান মাসুদের (Redwan Masud) একটা কথা খুব মনে পড়ছে তিনি বলছেন, “যেখানে জনগণ ভোটের সময় টাকা খেয়ে ভোট দেয় সেখানে নেতারা কখনও জনগণের বন্ধু হতে পারে না, হয় শোষক।” আমাদের রাজ্যে খেলা-মেলার রাজনীতির চাবিকাঠিটা লুকিয়ে আছে জনকল্যাণকর কাজের নাম করে সস্তায় ভোট কেনার রাজনীতির মধ্যে। তেমনই একটি বহু আলোচিত প্রকল্পের নাম হলো “লক্ষ্মীর ভান্ডার”। যে প্রসঙ্গে মহম্মদ সেলিম বলতে গিয়ে লিখেছেন,”….আর একটি আর্থিক প্রকল্প হল লক্ষ্মীর ভান্ডার যেটি ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে চালু হয়েছিল। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সমস্ত মহিলাদের একটি নিয়মিত আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়। কিন্তু যে রাজ্যে এই ধরনের প্রকল্প চালু করে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলা হচ্ছে, সেই রাজ্যে কর্মসংস্থানের পরিস্থিতি ভয়ংকর ভাবে নিম্নমুখী। গত বার বছরে কোন উল্লেখযোগ্য শিল্প তৈরী হয়নি, কৃষি থেকে আয় কমেছে, শিক্ষিত ছেলে মেয়েদের শিক্ষাক্ষেত্রে বা অন্য কোথাও চাকরির সুযোগ কমেছে। পুরুষের পক্ষে অন্য রাজ্যে গিয়ে কাজ করা সম্ভব হলেও, মেয়েদের পক্ষে এখনও তা সম্ভব নয়। ফলে নারীর ক্ষমতায়নের যে প্রাথমিক শর্ত, অর্থাৎ আর্থিক স্বনির্ভরতা- সেটাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাস্তবে এই প্রকল্পগুলি হল শিশুর হাতে ললিপপ ধরিয়ে দিয়ে ভাতের থালা সরিয়ে নেওয়ার মত।” [মার্কসবাদী পথ, নভেম্বর, ২০২৩]

বর্তমান রাজ্য সরকার তাদের কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে তাদের মনোভাব স্পষ্ট করেছে। তারা প্রতিবাদীদের মুখ বন্ধ করতে যতটা ব্যস্ত আসল অপরাধীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার জন্য তার ঠিক ততটাই উদাসীন। এই উদাসীনতা মোটেই অনিচ্ছাকৃত নয়। পরিকল্পিত। এ থেকেই মুখ্যমন্ত্রীর মনোভাব স্পষ্ট। বরাবরই তিনি কোন সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। কখনোই নিজের ভুল স্বীকার করেন না। যে ভুল তিনি করেন বারবার বারবার জোড়ের সাথে তিনি সেই একই ভুল করেন এবং বলেন। মহাকাশচারী হিসেবে রাকেশ রোশনের’র নাম একবার বললেও গোয়েবেলসের থিওরী অনুযায়ী ওই একই ভুল বারবার বলে মিথ্যাকেই তিনি সত্য বলে প্রমাণিত করতে চান। আর. জি. করের ঘটনার পর পুলিশ কমিশনার ও তৎকালীন সুপার নির্যাতিতার নাম প্রকাশ্যে বলে যেভাবে আইন ভেঙেছেন তার প্রতিকার বা তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার ব্যবস্থা যে মুখ্যমন্ত্রী নেবেন না সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং মমতা ব্যানার্জি যত দিন পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীর পদে থাকবেন ততদিন পার্কস্ট্রিট থেকে আর. জি. করের ঘটনার সুবিচার পাওয়া যাবে না, যেতে পারে না। আবার গোটা তৃণমূল দলটা মমতা ব্যানার্জিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। তৃণমূলের যাবতীয় পাওয়া না পাওয়ার এক ও একমাত্র ব্ল্যাঙ্ক চেক মমতা ব্যানার্জি। অতএব মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা ব্যানার্জি সরে গেলেই যে এর সমাধান ঘটবে এমন আশা নিশ্চয়ই কেউ করছেন না। তাই JUSTICE যদি সত্যি সত্যিই চাইতে হয় তবে এই সরকারটাকে সরাতে হবে। তা না হলে এত আন্দোলনের, এত রাতজাগা সব বৃথা যাবে। যেমন ভাবে মেলা-খেলা-নির্যাতনের রাজনীতি চলছে সেটাই চলবে। তিলত্তমা সুবিচার পাবে না। তাই শুধু মাথা নয়, দৈত্যটার পায়ের দিকে লক্ষ্য করুন। দেখবেন দূর থেকে যাকে দৈত্য বলে মনে হচ্ছে তার পাটাও মাটির সাথে সাথেই আছে। দরকার একটা জোরদার ধাক্কার…ঝুরঝুর করে সব পড়বে।