বামপন্থীদের বিশেষত কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রবিরোধিতার অপবাদ চাপিয়ে দেওয়ার ইতিহাস প্রায় আশি বছরের পুরোন। প্রয়াত জননেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্মরণসভার সূচনায় ভারতীয় গণনাট্য সংঘ (পশ্চিমবঙ্গ ) থেকে আশিজন শিল্পীর সমবেত কন্ঠে দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত সেই অপবাদকে নিছক অপবাদ হিসাবে আবার নতুন করে প্রমাণ করল । উন্নত সাংস্কৃতিক আদর্শের প্রতি কমিউনিস্টদের দায়বদ্ধতা অবশ্য নতুন ঘটনা নয়, কিন্তু ২২শে আগস্ট ২০২৪ তারিখটি নিঃশব্দে
বামপন্থী ছাত্র যুব আন্দোলনের ইতিহাসেও স্মরণীয় দিনের তালিকায় চিহ্নিত হয়ে উঠল শুধুমাত্র প্রয়াত কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্মরণসভায় অগণিত মানুষের মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ দাশের গান শোনার কারণেই নয় ,বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্বপ্ন দেখা ছিল যাঁদের ভবিষ্যৎ ঘিরে সেই ছাত্র যুবদের উদ্যোগে প্রকাশিত একটি বুলেটিন এবং একটি বইয়ের কারণেও। সেদিন দুপুরে যাঁরা প্রয়াত জননেতার স্মরণসভায় উপস্থিত হয়েছিলেন ভারতের ছাত্র ফেডারেশন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শেষ যাত্রার দিন ৯ ই আগস্ট প্রকাশিত “ছাত্রসংগ্রাম” পত্রিকার বুলেটিনের কপি তাঁদের হাতে পৌঁছেছে। আগের দিন ২১শে আগস্ট ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনের প্রাক্তন সর্বভারতীয় সম্পাদক তথা সিপিএম,আই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক মহম্মদ সেলিম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছিলেন যুবশক্তি পত্রিকায় প্রকাশিত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নিবন্ধ সাক্ষাৎকার এবং অনুদিত কবিতার নির্বাচিত সংকলন “স্বপ্ন দেখব বলে” । এই বইটিকে নিয়েও নেতাজি ইণ্ডোর স্টেডিয়ামে রীতিমত কাড়াকাড়ি হতে দেখেছি ২২শে আগস্ট বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্মরণসভায়।

“কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ ” এই শ্লোগান ছড়িয়ে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বেকার যুবক যুবতীদের কর্মসংস্থানের দিশা দেখানো প্রয়াত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রতি ভারতের ছাত্র ফেডারেশন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির শ্রদ্ধাজ্ঞাপন স্বরূপ বিশেষ বুলেটিন তাঁর প্রয়াণের পরদিন প্রকাশ করেছিল প্রথম পাতার শীর্ষে সুকুমার রায়ের লেখা কবিতার কয়েকটি লাইনের পুনর্মুদ্রন করে –

“আজকে দাদা যাবার আগে
বলব যা মোর চিত্তে জাগে
নাইবা তাহার অর্থ হোক
নাইবা বুঝুক বেবাক লোক।
আপনাকে আজ আপন হতে
ভাসিয়ে দিলাম খেয়াল স্রোতে ।”

সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকার সময় পশ্চিমবঙ্গে নতুন শিল্প গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে সেসময় রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বাত্মক বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল এ কথা আজ কারুর অজানা নয়। সিঙ্গুর ,নন্দীগ্রাম শালবনিতে বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চেষ্টা পদে পদে বাধাপ্রাপ্ত হয় নৈরাজ্যবাদী রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণে। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের বাজারি গণমাধ্যমের নেতিবাচক ভূমিকার কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মাওবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের ব্যক্তিহত্যা ও নাশকতার রাজনীতির সমালোচনা করার চেয়ে তাঁরা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ব্যর্থ প্রশাসক ও কৃষক স্বার্থ বিরোধী প্রমাণ করতে বেশি ব্যস্ত ছিল। কৃষিজমিতে শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের “বাস্তববোধের অভাব ” নিয়ে লম্বা লম্বা সম্পাদকীয় ছাপা ও বিশ্লেষণ প্রচার করা খবরের কাগজ এবং চিটফাণ্ডের টাকায় গজিয়ে ওঠা টিভি চ্যানেল কখনও বলেনি যে, পশ্চিমবঙ্গে নগরোন্নয়নে যেমন কৃষিজমি ব্যবহার করতে হয়েছে শিল্প স্থাপনের জন্যও তেমনই কৃষিজমি ব্যবহার করতে হবে কারণ উর্বর কৃষিজমির রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়াই স্বাভাবিক। শিল্প প্রতিষ্ঠান সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে জমি কিনে নিয়েই কারখানা তৈরি করে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য,নিরুপম সেনরা চাইছিলেন কৃষকদের যেন জমি নেওয়ার সময় শিল্পপতিরা দামে ঠকাতে না পারে। নজির বিহীন এমন ভাবনা চিন্তা ,হাইওয়ে আটকে দিনের পর দিন মারা বেঁধে বসে থাকা বিরোধী দলনেত্রীকে পুলিশ দিয়ে তুলে না দেওয়া – প্রভৃতি পদক্ষেপ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে বামফ্রন্টকে ভোট দেন এমন ব্যক্তিদেরও হতাশ করেছিল। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তিনি বলতেন ” আমি এমন কোনও পদক্ষেপ নিতে পারবো না ,যাতে আমাকে গণতন্ত্র বিরোধী হিসাবে চিহ্নিত করা যায়!” এমন একজন মানুষের বিদায়গাথায় তো “আপনাকে আজ আপন হতে / ভাসিয়ে দিলাম খেয়াল স্রোতে!” উদ্ধৃত করা যেতেই পারে।

এই বুলেটিনে প্রকাশিত দুটি নিবন্ধের মধ্যে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের একটি বক্তৃতাকে নিবন্ধ আকারে মুদ্রিত করা হয়েছে। ২০১৩ সালে শারদ ছাত্র সংগ্রাম পত্রিকায় জন বিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মীসভায় প্রদত্ত বক্তব্যের লিখিত রূপে দেখা যাচ্ছে, ২০০১ সালে পেন্টাগনে ৯/১১ র হামলার পর সন্ত্রাসবাদীদের মোকাবিলা ও দমনের অজুহাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যিক আধিপত্য বিস্তার করার লক্ষ্যে মধ্য প্রাচ্য ও লাতিন আমেরিকায় আগ্রাসনের যে কৌশল গ্রহণ করেছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন,বিশ্বের বাজার দখল করার লড়াইয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে উঠে আসা চিন তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটিয়েছিল সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের অর্থনীতির পথ ধরে। কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থনীতির ফলে উদ্ভূত বেকার সমস্যা দারিদ্র্য বিশেষত আয়ের বৈষম্য সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পক্ষে সমাধান করা সম্ভব সেই বিশ্বাসে দাঁড়িয়ে থেকেই তিনি প্রশ্ন করেছেন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির যে অর্থনীতির সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে তা মোকাবিলার রাস্তা কি? সেখানেও ধর্মীয় ও জাতিবিদ্বেষের মৌলবাদের সম্পর্কে সতর্ক করেছেন তিনি।
১৯৯৪ সালে ছাত্র সংগ্রাম পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত “ভাবনা দুর্ভাবনা” শিরোনামের নিবন্ধে ছাত্র আন্দোলনে সাংস্কৃতিক কর্মসূচির গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। মনে রাখতে হবে এই নিবন্ধ লেখার সময়কাল ভারতে বাজার অর্থনীতির প্রচলন হওয়ার প্রথম দিকে ,যখন সংস্কৃতিচর্চায় ভোগবাদের ছায়া ঘনিয়ে আসছে । পরিবর্তন আসছে সাহিত্যে । পাল্টাচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধ। এই সময়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কলমে আসছে ,” টপ লেস এ দেশে আসা কি উচিত? হায় ! যে দেশের অর্ধেক মানুষের এখনো জামা কেনার পয়সা নেই। তাতে তোমার কি? নিজে বাঁচো । দুর্নীতি, অপরাধ,যে পথেই হোক!” এই বিদ্রুপের একটি প্যারালাল পরেই তাঁর সংকল্প উচ্চারণ,” আমরা এক অন্ধকার স্রোতের মুখোমুখি। সমাজের অসাম্যকে ভাঙতে চাই। গণতন্ত্র চাই সকলের জন্য। অর্থনৈতিক সাম্য ছাড়া গণতন্ত্র অর্থহীন। চাই প্রগতি ,শিক্ষা । না হলে ধর্মনিরপেক্ষতা বার বার ব্যর্থ হবেই। আমরা চাই অখণ্ড ভারত। সমাজ বাদ দিয়ে সংস্কৃতি চিন্তা অর্থহীন ।”
আর জি কর হাসপাতালের পিজিটি চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার বিচার চেয়ে গড়ে ওঠা গণ আন্দোলনের আবহে ২২শে আগস্টের সংস্করণে এই বুলেটিনে যুক্ত হয়েছে “নারী নিরাপত্তার প্রশ্নে “শীর্ষক বিশেষ ক্রোড়পত্রে ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের নেত্রীদের লেখা একগুচ্ছ নিবন্ধ মধুশ্রী মজুমদার,দিধীতি রায়,বেদত্রয়ী গোস্বামী, বর্ণনা মুখোপাধ্যায় ও দীপ্সিতা ধরের লেখা । যখন প্রয়াত জননেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শেষ যাত্রায় পা মেলানো সহযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ উল্টেপাল্টে দেখছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নিবন্ধ এবং অনুদিত ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি ও বার্টোল্ড ব্রেখটের কবিতা তখন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে তিলোত্তমার লাশ পাচার করার চক্রান্ত চলছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আর জি কর হাসপাতাল চত্বরে পৌঁছে মীনাক্ষী মুখার্জী ,ধ্রুবজ্যোতি সাহা কলতান দাশগুপ্তরা পুলিশকে চ্যালেঞ্জ করে শববাহী গাড়িটি আটক করবেন।
খুব স্বাভাবিকভাবেই এই বুলেটিনটি আবার তরুণ প্রজন্মের নেত্রীদের প্রতিবাদী নিবন্ধ সহ ২২শে আগস্ট নেতাজি ইণ্ডোর স্টেডিয়ামে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্মরণ সভা উপলক্ষে নিয়ে আসা জরুরি ছিল। কারণ ,ধর্ষিতা ও নিহত চিকিৎসকের সুবিচার চেয়ে নানা বয়সের নারীদের ডাকে ১৪ ই আগস্ট রাতে “রিক্লেইম দ্য নাইট “আন্দোলনের ঢেউ কলকাতা থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল গ্রাম বাংলার মাটিতেও। সেই প্রতিবাদের আন্দোলন আরও জোরদার হয়েছে ১৪ ই আগস্ট রাতে উত্তর কলকাতা ও সন্নিহিত উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে জড়ো হওয়া তৃণমূল কংগ্রেসের পোষা গুণ্ডাদের হাতে আর জি কর হাসপাতাল ভাঙচুর হওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব‍্যানার্জী এই অপরাধের দায় এস এফ আই, ডি ওয়াই এফ আই এর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ায় তাঁর বশংবদ পুলিশ এস এফ আই ,ডি ওয়াই এফ আই এবং সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির নেতৃত্বকে লাল বাজারে সদর দপ্তরে ডেকে পাঠানোর পরে। উই ওয়ান্ট জাস্টিস শ্লোগানের সঙ্গে ছাত্র যুবদের যোগ নতুন শ্লোগান “ফাইট ফর জাস্টিস!” ছাত্র ফেডারেশনের প্রকাশিত ছাত্র সংগ্রাম এর বুলেটিনে দেখা গেল মধুশ্রী মজুমদার খুব সরাসরি মনুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার জন্য উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরেছেন মনু সংহিতা কে । তাঁর ব্যাখ্যা শেষ হয় এই ভাষায় “এই সমাজ প্রতিদিন বোঝায়,একজন মহিলা কখনোই একজন ব্যক্তি হিসাবে স্বাধীন নাগরিক হিসাবে বেঁচে থাকতে পারে না।” মধুশ্রী সঙ্গত প্রশ্ন তুলেছেন,” রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মহিলা হওয়ার পরেও কেন আজ নারীরা ধর্ষিতা হচ্ছে? কেন ছাত্রীরা নিরাপদ নয় শিক্ষাক্ষেত্রে? ” সমাজে মহিলাদের অবস্থাই সমাজের অগ্রগতির অবস্থা নির্ণয় করে ! মনে করিয়ে”লিখেছেন “ধর্ষণের সংস্কৃতি প্রমোট করে মনুবাদ । মনুবাদই মনে করে একজন নারীর ওপর একজন পুরুষের আধিপত্য কায়েম করাই উচিত । তাই আধিপত্য কায়েমের মাধ‍্যম হিসাবে ধর্ষণ খুব সহজ হাতিয়ার এদের কাছে।” তারপরেই আর জি কর হাসপাতাল যে শুধুমাত্র একটি চিকিৎসাকেন্দ্র নয় একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অর্থাৎ মেডিক্যাল কলেজ সে কথা মনে করিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন তিনি ,” যে কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশাখা গাইড লাইন অনুযায়ী জি এস ক্যাশ এবং আইসিসি থাকা বাধ্যতামূলক। কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষাক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা রুখতে এবং যৌন নিরাপত্তা বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে এই জি এস ক্যাশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। যা আসলে কাজের জায়গায় লেখাপড়ার জায়গায় মেয়েদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য জরুরি।”দিধীতি রায়ের সঙ্গত ক্ষোভ,”আমাদের রাজ্যের বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এগুলো কার্যকরী নেই। এমতাবস্থায় সরকার মেয়েদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য নিদান দিলেন,রাতের শিফটে মেয়েদের যথাসম্ভব কাজ না করা “। অর্থাৎ মহিলাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য মহিলাদের গতিবিধি,পরিসরকে নিয়ন্ত্রণ করার ফতোয়া।”
সর্বভারতীয় ছাত্রনেত্রী দীপ্সিতা ধরের লেখাটি অবশ্যই স্মরণীয় আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ধর্ষিতা নিহত তরুণী চিকিৎসকের জন্য সুবিচার চেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে অংশগ্রহণের দিশা দেখানোর কারণে। দীপ্সিতা লিখেছেন , তবু ভেঙে যাচ্ছে ব্যারিকেড,থিয়েটার কর্মী ,একটু কম নামজাদা গায়ক, ঠোঁট কাটা দু একজন অভিনেত্রী, ছাত্র যুব আন্দোলনের কর্মীরা ,ট্রান্স,কুয়ার একটিভিস্টস আর হাজারে হাজারে মানুষ পথে নামছেন রোজ। কী সাহসে কী জেদে উড়িয়ে দিচ্ছেন শাসকের চোখ রাঙানি । রাতের দখল,দিনের বদল আনতে ,টিকলি ঝুমদের ভয়হীন আগামীর জন্য,স্বৈরাচারীর পতন চেয়ে জোট বাঁধছে জনগণ। তারা সবাই সব বুঝে গেছেন? নাহ্! তবে শিখছেন, ভাঙছেন প্রশ্ন করছেন,আপাতত আমাদের কাজ তাঁদের সঙ্গে থাকা,সামনে নয়। আমাদেরও শিখতে হবে ভাঙতে হবে রোজ । পিতৃতন্ত্রের বীজ অনেক গভীরে, সমূলে তুলে আনতে হবে ভিতর থেকে ,নারী পুরুষ নির্বিশেষে।” দীপ্সিতা ধর স্পষ্ট উদাহরণ দিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজের পিতৃতান্ত্রিকতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন,”কী করে গড়ে ওঠে ধর্ষকাম মানসিকতা? যেমন ধরেন আপনি বললেন,গা দেখিয়ে রীল বানানো বন্ধ কর ,তারপর না হয় রাত দখল করবি,- আপনার কী বোর্ডের ১২০ শব্দ অস্ফূটে জানান দিলো ,গা দেখানো মেয়েদের জন্যই ধর্ষণ হয়। অথবা ধরা গেল কোন রাজনৈতিক কেউকেটা মাইকে দাঁড়িয়ে বললেন,বব কাট চুল ও জিন্স পরা মেয়েরা খালি আন্দোলন করছেন; দাদার মঞ্চের নীচে হাততালি দিতে থাকা ভক্তকুল বুঝলো পরের বার অসভ্যতা করার আগে মেয়েটার চুলের দৈর্ঘ্য আর প্যান্ট এর ধরণটা মেপে নিলেই সাতখুন মাফ।”
বেদত্রয়ী গোস্বামীর নিবন্ধে সরাসরি লেখা হয়েছে,” তৃণমূল সরকার আসার পর থেকে আজকে পর্যন্ত এরকম আরো অনেক ঘটনা ঘটে গেছে রাজ্যে,কিন্তু প্রায় সব ক্ষেত্রেই অপরাধীদের আড়াল করে পশ্চিমবঙ্গকে অপরাধের মুক্তাঞ্চল রাজ্য বানাতে চেয়েছে তৃণমূল দল এবং তার সুপ্রীমো ।” একই সঙ্গে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন,” ২০২১ সালের The National Crime Record Bureau এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী দেশে প্রতিদিন প্রায় ৮৬টি ধর্ষণের অভিযোগ রিপোর্ট হয়,আসল সংখ্যাটা নিঃসন্দেহে আরও অনেক বেশি। ছাড়া পেয়ে যায় বিলকিস বানোর ধর্ষকেরা। ভারতীয় জনতা পার্টি তাদের ফুল মালা দিয়ে বরণ করে। ভারতের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দীর্ঘতম বক্তৃতা দিয়ে রেকর্ড গড়েছেন আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ,অথচ মণিপুরের মহিলাদের যখন নির্যাতনের পরে নগ্ন করে মিছিলে হাঁটানো হয় এবং দেশ জুড়ে সেই ভিডিও ভাইরাল হয়,তা নিয়ে ওনাকে কথা বলতে শোনা যায় না। দোষীদের শাস্তি হয় না, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে প্রমাণ লোপাটের। কোর্ট পুলিশকে ভর্ৎসনা করে সঠিক তথ্য দিতে না পারার জন্য। কিন্তু তাতে নির্যাতিতা সুবিচার পায় কি?”

বর্ণনা মুখোপাধ্যায়ের নিবন্ধের শুরুতেই উঠে এসেছে সেই সন্ধ্যার স্মৃতি ,”প্রশাসনের পক্ষ থেকে তড়িঘড়ি পোস্ট মর্টেম করে মা বাবার অজান্তেই ন্যায় বিচারের দাবিতে ইনসাফ চাওয়া একদল ছাত্র যুবদের প্রায় গায়ের উপর দিয়েই শববাহী গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হল মেয়েটির সোদপুরের বাসভবনে । কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পানিহাটি অঞ্চলের তৃণমূল ও পুলিশের তত্ত্বাবধানে প্রমাণ লোপাটের স্বার্থে দাহ করা হলো মেয়েটির ক্ষতবিক্ষত দেহটা। ” বর্ণনার লেখাতেও এসেছে, কখনো পোশাক কখনো সময় কখনো আবার সঙ্গী- ধর্ষণের সংস্কৃতিকে মান্যতা দিতে একাধিক প্রতিবন্ধকতার ব্লু প্রিন্ট তৈরি করে পুঁজিবাদ । তিনি লিখেছেন,” লক্ষ্য একটাই,নারীর শ্রমশক্তির বিকাশ রুখে দেওয়া। মনুবাদ বা শরিয়ত শাসনও এই মডেলকে ধরেই যুক্ত করেছে আরও হাজারো বিধিনিষেধ। অথচ সভ্যতার আদিমে আঁধারের দখল ছিল মেয়েদের হাতেই। শ্রম বিভাজনের ধারায় পুরুষের শারীরিক কাঠামোর অগ্রাধিকার বাক্সবন্দী করলো মেয়েদের। ” নিবন্ধের শেষে তাঁর প্রত্যয় এই ধারাবাহিক আন্দোলনের শেষে আমাদের জয় নিশ্চিত। এই ধারাবাহিক গণ আন্দোলনে জনগণের জয় সুনিশ্চিত। “

এই অকিঞ্চিৎকর রচনা প্রধানত আগামীদিনে পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী গণ আন্দোলনের নেতৃত্ব যাঁদের হাতে থাকবে সেই ছাত্র সমাজের প্রতিনিধিদের চিন্তা চেতনার গভীরতা ও আদর্শবোধের দৃঢ়তা সম্পর্কে পূর্ববর্তী প্রজন্মের একটি ধারণা তৈরি করার জন্য। জননেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্মরণসভাকে সামনে রেখে প্রকাশিত ছাত্র সংগ্রাম পত্রিকার বিশেষ বুলেটিন বুঝিয়ে দিল, বিশেষত ছাত্রীরা মতাদর্শগত চর্চায় নিজেদের চেতনাকে শানিত করে সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার স্পর্ধা অর্জন করেছেন।