আসল কথা হারায় নি। খবরের কাগজ ছোট করেও ছাপতে বাধ‍্য হয়েছে পেট্রোল ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ার খবর। অনেক মানুষেরই ক্ষুধা মেটেনি, হাতে কাজ আসেনি, কৃষক ফসলের ন‍্যায‍্য দাম না পেয়ে প্রতারিত হয়েছেন,স্বাস্থ‍্যসাথী কার্ডের বরাদ্দ ছাপিয়ে যাচ্ছে হাসপাতালের বিল। কেননা অষ্টাদশ লোকসভা কেন্দ্রে শরিকদের নিয়ে একক বৃহত্তম দল বিজেপি সরকার গড়েছে এবং আমাদের পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস বেশি আসনে জিতে বিজেপি বিরোধী ঐক‍্যে বাম কংগ্রেসের প্রভাব খর্ব করার পরিকল্পনা সাজাতে ব‍্যস্ত। এবং কি আশ্চর্য লোকসভা নির্বাচনের শেষ পর্বে মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে মমতা ব‍্যানার্জী বিজেপির হাতে সাম্প্রদায়িক প্রচারের অস্ত্র তুলে দিয়েছেন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ‍্যে আক্রমণ করে – তা সত্ত্বেও এক শ্রেণীর রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে সফলভাবে মোকাবিলা করার কৃতিত্ব দিচ্ছেন মমতা ব‍্যানার্জীকে। কলকাতা পৌর এলাকায় বিজেপির ভোট বেড়ে যাওয়ায় কোন আশঙ্কা অনুভব করছেন না এই প্রাজ্ঞজনেরা। যদি এই যুক্তি খাড়া করা হয় যে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে শক্তিশালী বিরোধী পক্ষ ভেবে নরেন্দ্র মোদির মুখ মনে রেখে বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে,তাতে তো বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চরিত্র মিথ‍্যা হয়ে যায় না। বরং হয় তৃণমূল নয় বিজেপি – তৃতীয় কোন পক্ষ নেই বা থাকলেও ধর্মনিরপেক্ষ হলেও পশ্চিমবঙ্গে কোন রাজনৈতিক দল বা জোট তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতা করলে তাকে প্রচারের আলোয় না নিয়ে আসার যে পরিকল্পনা বাজারি মিডিয়ার ছিল তা সফল হয়েছে,ভোটের ফলে পশ্চিমবঙ্গে প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তির বিপর্যয় সেই কথাই প্রমাণ করেছে। ডায়মণ্ড হারবার কেন্দ্রে অভিষেক ব‍্যানার্জীর বিপুল ভোটে জয়ের আড়ালে একতরফা অগণতান্ত্রিক ভোটগ্রহণের অভিযোগ চাপা পড়ে গেল। চাপা পড়ে গেল ডায়মণ্ডহারবারে বিজেপি প্রার্থীর অভিযোগ,” অভিষেক ব‍্যানার্জীর টাকায় পশ্চিমবঙ্গের রাজ‍্য বিজেপির অনেকেই রাজনীতি করেন।” নির্বাচনের ফলে বাম কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে বিপর্যস্ত,কিন্তু তাতে নিয়োগ দুর্নীতি ও রেশন কেলেঙ্কারির মাথারা ধরা পড়েনি, সংখ‍্যালঘু নির্যাতন কমেনি বরং নির্মম গণপিটুনিতে নিহত হচ্ছেন আমাদের দরিদ্র সহনাগরিকরা এবং তারই পাশাপাশি দাপটে হকার উচ্ছেদ শুরু করেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রীমো পশ্চিমবঙ্গের মুখ‍্যমন্ত্রী কোনও পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি ছাড়াই। চোখের জলে ভাসছেন সেইসব দরিদ্র মানুষেরা যাঁরা অনেকেই তৃণমূল কংগ্রেস কে ভোট দিয়েছেন। কাজেই বামপন্থীদের লড়াই চলবে। কারণ মানুষের বাঁচার অধিকার বিপন্ন।

পশ্চিমবঙ্গ,ত্রিপুরা ও কেরালায় বামপন্থীদের সমর্থনভূমিতে ক্ষয় ধরানোর জন‍্য আর এস এস বহুদিন ধরেই সক্রিয়। গত দশ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় সামাজিকভাবে নিজেদের প্রভাব এবং মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। ধর্মকে মিশিয়ে ঘৃণা ভাষণের প্রচারকে সফলভাবে মোকাবিলা করার সামাজিক কৌশল এখনো বামপন্থায় বিশ্বাসী সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলো রপ্ত করে উঠতে পারেন নি। কমিউনিস্ট পার্টি বা বামপন্থী রাজনৈতিক দলের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধী প্রচার এক্ষেত্রে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সমাজে তার পরিপূরক সাংগঠনিক সাংস্কৃতিক প্রচার চাই যা হরিসংকীর্তন বা গণেশ পূজা ও হনুমান জয়ন্তীর আসর থেকে আর এস এসের প্রচারকে ছাপিয়ে যেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে কমিউনিস্ট পার্টির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থামিয়ে দেওয়ার ইতিহাস আছে, দাঙ্গা কবলিত মানুষকে উদ্ধার করার ইতিহাস আছে কিন্তু সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বীজ সমাজের বুক থেকে উপড়ে ফেলার রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও তাতে ভাঁটার টান অস্বীকার করার উপায় নেই। এদেশে দারিদ্র্য ও বঞ্চনার সুযোগে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি বিকশিত হয়েছে তেমনি কর্পোরেট সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বিক্ষোভকে বিপথে পরিচালনা করার জন‍্য কখনও ধর্মীয় বিভাজন কখনও জাতিগত বিভাজনকে কাজে লাগিয়েছে।

অনেক ধর্মনিরপেক্ষ নির্বাচক উত্তরপ্রদেশে দোর্দণ্ড প্রতাপ যোগী আদিত‍্যনাথের নেতৃত্বে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব ও কংগ্রেসের রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক বোঝাপড়ার সাফল‍্যের উদাহরণ দিচ্ছেন,কিন্তু সেটা নেহাতই বিজেপি বিরোধী ভোট বিভাজন ঠেকিয়ে দেওয়ার কৌশল। এই সাফল্য স্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম। বামপন্থী রা ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজনের সামাজিকভাবে মোকাবিলার পথ খুঁজছেন কারণ সেই উন্নত প্রগতিশীল ভাবনার স্থায়ী প্রতিফলন রাজনৈতিক লড়াইয়ের ওপর পড়বে। আপাতত সাম্প্রদায়িকতা ও দুর্নীতি বিরোধী সমমনস্ক সহনাগরিকদের বৃত্ত বাড়ানোর কাজটা করা ছাড়া কোন পথ সামনে খোলা নেই।